
বরগুনার বেতাগী উপজেলার বিষখালী নদীর তীরবর্তী কাজিরাবাদ ইউনিয়নের উত্তর কালিকাবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা জেলে খবির গাজী (৫০)। ১০ বছর বয়েস থেকেই যার মাছ শিকার শুরু। প্রতিবন্ধী মেয়ে সহ ৭ সদস্যর সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। বিষখালী নদীতে মাছ শিকার করে যা আয় তা দিয়েই চলছিলো কোনমতে সংসার। মা ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে মাছ ধরার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় বেকার হয়ে অসহায়াত্বের মধ্যে পড়েছেন তিনি। চলছে অভিযান। জব্দ করে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে জাল। এখন সংসারের ব্যয়, সঙ্গে ঋণের কিস্তি আর দাদনের চাপে চিন্তিত হয়ে বিনীদ্র রাত কাটাচ্ছেন।
এখানকার জেলে শুধু খবির গাজী নয়, উপজেলার বুড়ামজুমদার গ্রামের ময়ুর জান (৫০) ও গ্রামার্দ্দন গ্রামের রোকেয়া বেগম (৪৫), বদনীখালী গ্রামের আনোয়ারা বেগম (৪৫), বলাইবুনিয়া গ্রামের মনা (৩৪), সুজন (৪০), তালবাড়ি গ্রামের মো: বেল্লাল (৪৫),আল-আমিন (৩৫), কাজিরাবাদের উত্তর কালিকাবাড়ি গ্রামের মো: ফারুক মীর (৪৫), জালাল মীর (৪৮), সড়িষামড়ি ইউনিয়নের কালিকাবাড়ী গ্রামের মহিবুল্লাহ পালোয়ান (৩৫), হালিম সিকদার (৪৫), দক্ষিন কালিকাবাড়ী গ্রামের মো: মিরাজ (৪৫), আফজাল ভান্ডারি ( ৪৫), আলীয়াবাদ গ্রামের মো: ফারুক (৫০), মোকামিয়া ইউনিয়নের বড় মোকামিয়া গ্রামের আলম মল্লিক (৩৫), ছোট মোকামিয়া গ্রামে জাকির হোসেন (৫০), মুনসুর বয়াতী (৫৫), হোসনাবাদ ইউনিয়নের হোসনাবাদ গ্রামের মো: রিয়াজ (৫৫), বেতাগী সদর ইউনিয়নের ঝোপখালী গ্রামের মো: শাহীন (৫০), মো: সুজন (৪৫), বিবিচিনি ইউনিয়নের বিবিচিনি গ্রামের তৈয়ব আলী (৫৫), আমজাদ হোসেন (৫০) ও বেতাগী পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের জিতেন দাস এরাই সবাই এ পেশার উপর নির্ভরশীল।
তাদের মতো বিষখালী নদীর কুলঘেষে গড়ে ওঠা দেড়লাখ জনসংখ্যা অধ্যূষিত একটি পৌরসভা সহ ৭টি ইউনিয়নের ৩ হাজার ১৮২ জন জেলের মাথায় এখন একই দুশ্চিন্তা। তারা বলছেন, আষাঢ় থেকে আশি^ন ইলিশের প্রধান মৌসুম। এর মধ্যেই ৬৫ দিনের এবং পরে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। সঙ্গে বৈরি আবহাওয়া এবং এমনিতেই নদীতে পর্যপ্ত ইলিশ পাননি এবার। নিষেধাজ্ঞায় যে চাল পেয়েছেন তাতে সংসার চলেনা। পরিবার নিয়ে না খেয়ে অতি কষ্টে ও মানবেতর জীবন পার করতে হয়। তার ঋণের ওপর কিস্তী। তাছাড়া ভরা মৌসুমেও ইলিশের আকাল জেলেদের জীবনে বড় কষ্ট ডেকে এনেছে।
বেতাগী উপজেলার একাধিক ইউনিয়নের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের পর থেকে এখানকার জেলেদের তালিকা হালনাগাদ হয়নি। এ উপজেলায় জেলের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৭৫ জন। তবে উপজেলা মৎস্য অফিস জানায়, বর্তমানে তালিকাভ’ক্ত নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩ হাজার ১৮২ জন। এর মধ্যে ৩ হাজার ১১১ জনের অনুক’লে ৭৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
জেলেদের অভিযোগ, পুরোনো তালিকায় পেশা বদলানো লোকদের নাম রয়ে গেছে, আর নতুন যারা পেশায় যুক্ত হয়েছেন, তারা সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত। এদের মধ্যে ৬৯ জনের নামে এখনো কোন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এসব জেলে পরিবারেও চরম হতাশা বিরাজ করছে। কবে নাগাদ তাদের অনুক’লে চাল বরাদ্দ হবে তা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে বঞ্চিত এসব জেলেরা।
বেতাগী পৌর শহরের মৎস্য ব্যবসায়ী মো. সুজন মিয়া বলেন, পরিবার চালানো এখন ভীষণ কষ্টকর হয়ে গেছে। জেলেরাই নয়, কর্মহীন হয়ে পড়েছেন শ্রমিক, ব্যবসায়ী, আড়তদার এবং স্থানীয় বাজারের বিক্রেতারা। অনেক আড়তদার ঋণ করে নৌকা ও জাল কিনেছিলেন, এখন ঋণ শোধ করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেকে পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন।
জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির বেতাগী উপজেলা সভাপতি মো: আব্দুর রব সিকদার বলেন‘ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বেকার হয়ে পড়া জেলেদের প্রণোদনা হিসাবে ২৫ কেজি করে যে চাল দেওয়া হয় তা দিয়ে তাদের সংসার চলছেনা। জেলেদের প্রতিনিধি হিসাবে উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে একাধিকবার উর্ধতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জেলেদের আর্থিক প্রণোদনার দাবি তুলে ধরেছি। দু:খের বিষয় অদ্যাবধি এর বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ সময়টায় জেলেরা চরম কষ্টে কাটাচ্ছে।’
বেতাগী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: তুরান জানান, এরই মধ্যে জেলেদের মাঝে বরাদ্দের চাল বিতরণ করা হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষায় অবরোধের সময়সীমা কিছুটা পিছিয়ে দেওয়ার এখন কেউ কেউ দাবি তুললেও কোন সূযোগ নেই। সরকার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার সময়-কালের ক্ষেত্রে আগেই এখানকার স্থানীয় জেলেদেরও মতামতের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তাদের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। ঐ সময় সকলেই একমত পোষন করেছেন।
জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচাল কামরুল হাসান বলেন, ‘জেলেদের আর্থিক প্রণোদনার দাবির বিষয়টি আলোচনায় আসছে। মূলত এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্বান্ত নেবে। জেলেরা যে দাবি আমাদের কাছে জানাচ্ছেন সেটা যদি মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা মহোদয়ের কাছে লিখিতভাবে জানাতে পারতেন সেটা নিয়ে তারা ভাবতে ও বিবেচনা করতে পারতেন।
এ বিষয় ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কিত বেতাগী উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার হরেকৃষ্ণ অধিকারী বলেন,‘সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মা ইলিশ রক্ষায় এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তিনি আশা করেন এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে এখানকার নদীতে ইলিশের প্রাচুর্য বাড়বে। তখন জেলেরা আরও বেশি মাছ ধরতে পারবেন, এখন সাময়িক কষ্ট হলেও যা তাদের জীবনে স্বস্তি আনবে।