গরমে ঘেমে ভেজা শরীর, ধুলাবালিতে ভরা মুখ আর চোখে ঝাঁঝালো করাতের গুঁড়ো-এই দৃশ্যটাই প্রতিদিন দেখা যায় বিয়ানীবাজারের প্রায় এক ডজন কাঠের স’মিলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরন্তর শব্দ তোলে করাতের ব্লেড। সেই শব্দের নিচে ঢাকা পড়ে যায় মানুষের নিঃশব্দ কষ্ট, ভয় আর জীবনযুদ্ধের গল্প।
এ বিষয়ে কথা হয় কথা হয় বিয়ানীবাজার পৌরশহরের দক্ষিণ বাজারে অবস্থিত একটি সো-মিলের প্রতিবেশী ব্যবসায়ী দেলোওয়ার হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, স’মিলে কাজ করা মানুষগুলোর জীবনের ঝুঁকি যেন তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। বিশাল বড় গাছের কাণ্ড তুলে দিতে হয় করাতের ধারালো ব্লেডের সামনে। সামান্য ভুলেই ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা-কখনও হাত কেটে যায়, কখনও বা চোখে উড়ে আসে করাতের গুঁড়ো।
অথচ এই ভয়াবহ ঝুঁকির বিনিময়ে তাদের মেলে মাত্র ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। এতো পরিশ্রম আর বিপদের মধ্যেও এই অল্প আয়ে চলে সংসার, চলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার সংগ্রাম।
হাদী নামের একজন শ্রমিক বলেন, ‘প্রতিদিন মনে হয় আজ না হয় কাল কিছু একটা হবে। কিন্তু না গেলে সংসার চলবে কেমনে?’ এই এক বাক্যেই যেন মিশে আছে হাজারো পরিশ্রমী মানুষের অদৃশ্য আর্তনাদ।
বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের সহযোগি অধ্যাপক আব্দুর রহিম বলেন, যে হাত কাঠ কেটে আমাদের ঘর সাজায়, সেই হাতেই রয়ে গেছে নিরাপত্তাহীনতা আর অবহেলার দাগ। আধুনিক শহরের উঁচু দালান আর ঝকঝকে আসবাবের পেছনে লুকিয়ে থাকে তাদের ঘাম, রক্ত আর প্রতিদিনের ভয়। অথচ তাদের প্রাপ্য সম্মান বা নিরাপত্তা এখনো অধরা।
বিয়ানীবাজার পৌরশহরসহ উপজেলার সো-মিলগুলো মনে করিয়ে দেয়-বিলাসীতা আর উন্নয়নের পেছনে আছে এমন শত শত অজানা মুখ, যাদের পরিশ্রম ছাড়া কোনো নির্মাণই সম্পূর্ণ হয় না। এসব সো-মিলে কর্মরত আছেন প্রায় দেড় শতাধিক শ্রমিক। যাদের জীবনের দু:খগাঁথা শুনলে যে কারো চোখে জল আসবে। জীবন বাস্তবতা উপলব্দি করা যায় তাদের কথা শুনলে।
তারা হয়তো আলোচনায় আসে না, কোনো পুরস্কার পায় না; তবু তাদের ঘামেই গড়ে ওঠে শহরের প্রতিটি কাঠের দরজা, জানালা, টেবিল আর চেয়ার।
বিয়ানীবাজার উপজেলা সুজন সভাপতি এডভোকেট আমান উদ্দিন বলেন, সো-মিল শ্রমিকদের জীবনের এই করুণ বাস্তবতা আমাদের ভাবায় জীবন কতটা কঠিন, তবু মানুষ বাঁচার আশায় কতটা শক্ত হতে পারে। হয়তো এটাই জীবনের সত্যিকারের সংজ্ঞা-ঝুঁকির মধ্যে থেকেও টিকে থাকার নিরন্তর লড়াই।