
ভোলার চরফ্যাশনে ঢালচর ইউনিয়নে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে বন। চলতি শুষ্ক মৌসুমে সংরক্ষিত বনের দুটি এলাকার প্রায় ১০০ একর বন উজাড় করে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মাছঘাট ও মাছের ঘের করেছে স্থানীয় ভূমি ও বনদস্যুরা। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে অর্ধশত ব্যক্তি বন কেটে বাড়িঘর নির্মাণ করছে।
এদিকে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা সংরক্ষিত বন উজাড়ে মহোৎসব চললেও তা বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না স্থানীয় প্রশাসন। দস্যুদের কবল থেকে বন উজাড় বন্ধ করতে না পারলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভোলাসহ উপকূলের বাসিন্দাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় ঢাল হিসেবে কাজ করছে ম্যানগ্রোভ বাগান। ঝড়-বাদলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা সাগর তীরের ঢালচরের সেই ম্যানগ্রোভ বাগান নির্বিচারে ধ্বংস করছেন বনদস্যুরা। সরেজমিন দেখা যায়, ঢালচরের চর সত্যেন মৌজার মাঝের চরে প্রায় ৭২ একর বনের গাছ কেটে গড়ে তোলা হয়েছে ঘরবাড়ি, মাছের খামার, হাটবাজার ও মাছঘাট। গত দুই মাস ধরে একাধিক এক্সক্যাভেটর দিয়ে বনের গাছ কাটা হচ্ছে। বনের এসব জায়গায় মাছের ঘের ও ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। বাগান আর মাছের ঘেড়ের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে কাটা গাছের স্তূপ। দ্রুত গাছ কাটার জন্য এক্সক্যাভেটর ব্যবহার করা হয়। মাঝের চরের স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদারের নামে এক বছর আগে স্থাপন করা হয়েছে ‘হাওলাদার বাজার’ নামের একটি বাজার। পাশেই মাছঘাট। ওই বাজারের দক্ষিণ পাশে চলছে বন ধ্বংস ও ঘর তৈরির কাজ। বন উজাড়ের জন্য বাজারের পাশেই চারটি এক্সক্যাভেটর রাখা হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, বাজারসহ পুরো এলাকা স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে। দূর-দূরান্ত থেকে সরকারি বা বেসরকারি কোনো ব্যক্তি এলেই তাদের ঘিরে রাখে একটি গ্রুপ। বন ধ্বংসকারীরা সবাই একই সিন্ডেকেটের হওয়ায় সব তথ্যই গোপন করে রাখেন।
বাজারের দক্ষিণ পাশের উজাড় করা বনের ডালপালা কাটতে দেখা’ মো. ইলিয়াছ নামের এক জেলেকে। তাঁর ভাষ্য, গত দুই মাস ধরে বন কেটে স্থানীয় মানুষ এখানে ঘরবাড়ি করছেন। ঢালচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বনের মধ্যেই ঘের করেছেন। গত কয়েক মাস ধরে ভেকু (এক্সক্যাভেটর) দিয়ে এসব ঘের করা হচ্ছে। বাজারের দক্ষিণ পাশে বন কেটে বাড়ি নির্মাণ করেছেন সাবেক মেম্বার মো. সফি। তিনি জানান, চারবার নদীভাঙনের পর এখানে এসে ঘর তুলেছেন। নিজের জমি না থাকায় তিনি নষ্ট হয়ে যাওয়া বন পরিষ্কার করে বাড়ি করেছেন। এর জন্য বন বিভাগের সাবেক এক কর্মকর্তাকে টাকাও দিতে হয়েছে।
এর পাশের আরেক বাসিন্দা ইকবাল হাসান, এখানে বাড়ি করতে গিয়ে বন বিভাগের তিনটি মামলার আসামি হয়েছেন তিনি। নদী ভাঙার কারণে এখানে বাড়ি করতে বাধ্য হয়েছেন- এমন দাবি ইকবালের। ওই বাজারে জামাল নামের এক ব্যবসায়ীর বক্তব্য, টাকা দিয়ে মরা গাছ পরিষ্কার করে ঘর তুলেছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করবেন এখানে। নদী ভাঙায় যাওয়ার জায়গা নেই, তাই ঘর করেছেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য মোস্তফা কমান্ডারেরও একই কথা। ঢালচরের নদীভাঙা মানুষগুলো এখানে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। হাজার হাজার গাছ কাটার চিহ্ন আর গাছের স্তূপ পথে পথে পড়ে থাকলেও ওই এলাকার সবার একই কথা, মরাগাছ পরিষ্কার করে বা বাগানের বাইরে তাঁরা ঘরবাড়ি করেছেন।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানান, চেয়ারম্যানের নির্দেশেই বনের মধ্যে ঘরবাড়ি করা হচ্ছে। মামলা মোকদ্দমা যাই হোক বনের মধ্যে ঘরবাড়ি তোলা অব্যাহত থাকবে। সবুজ ও কাজলের নেতৃত্বে অপর একটি গ্রুপ পূর্ব ঢালচর খালের দুই পাশের প্রায় ১০ একর বাগানের গাছ কেটে তৈরি করছেন মাছঘাট। সরকারি বাগান ঢালচরের প্রভাবশালী দুটি গ্রুপ নিজেদের সম্পত্তি মনে করে উজাড় করলেও মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না কেউ। এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় প্রশাসনের নজরদারির বাইরে রয়েছে বিষয়টি।
এদিকে প্রভাবশালী মহলের তোপের মুখে অনেকটা জিম্মি অবস্থায় রয়েছেন স্থানীয় বনকর্মীরা। প্রভাবশালীরা বিভিন্ন সময়ে বন বিভাগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ করে তাদের আতঙ্কে রাখেন। ওই চরের হাটবাজারের দোকানদারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বনকর্মীদের কাছে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি না করার জন্য। প্রকাশ্যে এমন ঘোষণায় মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন বনকর্মীরাও। এসব বনদস্যুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে হেনেস্তা হয়েছেন একাধিক কর্মকর্তাও। বন উজাড়ের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ঢালচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার। তিনি বলেন, নদীভাঙনের শিকার কিছু পরিবার বনের পাশের খোলা জায়গায় বাধ্য হয়ে ঘরবাড়ি করেছে। তাঁদেরে যাওয়ার জায়গা নেই। এ ছাড়া যে সব স্থানে ঘরবাড়িসহ স্থাপনা করা হয়েছে, সেসব জমি খাস। ইউপি চেয়ারম্যানের দাবি, আগের মাছঘাট ভেঙে যাওয়ায় মাঝেরচর খালপাড়ে মাছঘাট করেছেন জেলেরা। আর সেখানে কিছু দোকান করে তার নামে ‘হাওলাদার বাজার’ করেছেন জেলেরা।
ঢালচরের রেঞ্জ কর্মকর্তা চন্দ্র শেখর জানান, ১৯৭৬ সালের পর মাঝের চরে বনায়ন করা হয়েছে। নদীভাঙন কবলিত মানুষের আশ্রয়ের নামে মাঝের চরে প্রায় ৭৬ একর বন উজাড় করা হয়েছে। পূর্ব ঢালচরের খালের দুই পাশে ১০ থেকে ১২ একর বাগান কেটে মাছঘাট করেছে অপর একটি গ্রুপ। এ ঘটনায় তারা (বন বিভাগ) চারটি মামলা করেছে। বন কাটা সাময়িক বন্ধ করার পাশাপাশি বনের মধ্যে কাজ করার জন্য আনা চারটি এক্সক্যাভেটর জব্দ করা হয়েছে। তবে বনকর্মীদের হুমকি-ধমকির মাধ্যমে জিম্মি করে এখনও গাছকাটা চলছে বলে জানা গেছে। নির্বিচারে এমন বন উজাড়কে উপকূলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকি বাড়বে বলে মনে করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. তোতা মিয়া। জেলা উন্নয়ন ও স্বার্থরক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ রায় অপুর দাবি, বন রক্ষায় বনদস্যুদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনকে সমন্বিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
বিভাগী বন কর্মকর্তা এস এম কায়চার জানান, দখল করা বনের জমি উদ্ধারের চেস্টা চলছে।