একদল শিক্ষার্থী বাদ্যের তালে তালে গাইছে গান, ঠিক পাশেই শিক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন একজন শিক্ষক। বিদ্যালয়ের গেটে প্রবেশ করতেই কানে ভেসে আসছে ‘এমন যদি হতো আমি পাখির মতো, উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ’। বিদ্যালয়ে ব্যতিক্রম উদ্যোগ গ্রহণ করেন শিক্ষক আব্দুল মাজেদ। গান বাজনায় মুখরিত আনন্দময় এক বিদ্যালয়ে হয়ে উঠেছে এটি।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার সেনুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল মাজেদ। সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও আগ্রহের কারণে ইউটিউবে ভিডিও দেখে বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন তিনি। নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শিক্ষার্থীদের মাঝেও তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে সংগীতচর্চা, নাচ, অভিনয়সহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
সহশিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আব্দুল মাজেদের ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ বদলে দিয়েছে বিদ্যালয়টিকে। জানা যায়, ২০০৬ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন আব্দুল মাজেদ। বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে আব্দুল মাজেদ শিক্ষার্থীদের গণিত শেখাতেন। একদিন তাঁর মনে হলো, বিদ্যালয়ে শেখার মধ্যে আনন্দ নেই। শিক্ষাকে আনন্দময় করার পথ খুঁজতে লাগলেন তিনি।
২০১৫ সালে ইউটিউব ঘেঁটে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা শুরু করলেন। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষককে প্রস্তাব দেন, ক্লাসের বিরতিতে শিক্ষার্থীদের সংগীত ও বাদ্যযন্ত্র শেখানোর জন্য। প্রধান শিক্ষকের সম্মতি পেয়ে প্রথমে নিজের টাকায় একটি বাদ্যযন্ত্র ক্রয় করেন। তা দিয়েই শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলতে লাগল সংগীত শেখানোর আসর। বিদ্যালয়ে দেখা যায়, সাজানো-গোছানো বিদ্যালয়ের মাঠে সৌরভ শর্মা, সাদ আল মুনতাসীর, নুর হোসেনেরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গাইছে গান।
অপরদিকে গানের তালে তালে মিষ্টি, শাম্মিরা নাচছে। আব্দুল মাজেদ হাতবয়া বাজিয়ে তাদের সঙ্গ দিচ্ছেন। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সৌরভ শর্মা বলেন, আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, তখন থেকে গান শিখছি। এখন আমি অনেকগুলো গান গাইতে পারি। কাহন ও গিটার বাজাতে পারি। স্কুলের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চর্চা করি। এখন স্কুলে না এলে কেমন জানি লাগে। আরেক শিক্ষার্থী বাপ্পি হাসান বলেন, আগে স্কুলে নতুন কেউ এলে ভয় ভয় লাগত। এখন সেই ভয় আর নাই। স্যার (আব্দুল মাজেদ) আমাদের সব ভয় দূর করে দিয়েছেন।
ব্যতিক্রম উদ্যোগ গ্রহণ করা শিক্ষক আব্দুল মাজেদ বলেন, যেদিন সংগীতের ক্লাস চলে, সেদিন প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। এতে তিনি উৎসাহ পান, যা নজরে আসে প্রধান শিক্ষকেরও। তিনি বিদ্যালয়ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনার তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। যা দিয়ে কাহন, হাতবয়া, জিপসি ও গিটারের মতো বাদ্যযন্ত্র ক্রয় করা হয়। গান শেখানোর পাশাপাশি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে অন্য সহশিক্ষা কার্যক্রমও। একসময় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি আশানুরূপ ছিল না। এখন উপস্থিতি শতভাগ বললেই চলে। ঝরে পড়ার হারও শূন্যের ঘরে। নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কারও নিয়ে আসছে শতবর্ষী এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।