বরগুনার বেতাগীতে মাছ ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম (৫৫) কে অপহরণ করে হাতিয়ে নিয়েছে ৩ লক্ষ টাকা। এ ঘটনায় মামলা হলেও অপরাধীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কে কাটাচ্ছে অসহায় শহীদুল ও তার পরিবার। এতে নি:স্ব হয়ে কষ্টে কাটছে জীবন।
জানা গেছে, উপজেলার মোকামিয়া ইউনিয়নের কাইয়ালঘাটা এলাকার বাসিন্দা মৃত: হযরত আলী জোমাদ্দারের ছেলে শহীদুল ইসলাম মাছ ব্যবসা করে আসছিলো। সেই সুবাধে শহীদুলের কাছ থেকে একই উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের (কাটাখালী) বাসিন্দা আ: সালাম হাওলাদারের ছেলে আসাদুজ্জামান জীবন মাঝে মাঝে মাছ ক্রয় করার ফলে তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক পরিচয় হয়।
হঠাৎ করে গত ৭ ই মে আসাদুজ্জামান শহীদুলের বাড়িতে যান। তার কথিত ঘেরে চিড়িং চাষের জন্য গলদা রেনু পোনা ক্রয়ের উদ্দেশ্যে খোঁজ খবর নিতে। পুনরায় গত ৯ মে সন্ধায় আসাদুজ্জামান ঐ বাড়ীতে গিয়ে তার ০১৩৩২৫৮৮৭৪৪ নম্বর মুঠো ফোন থেকে শহীদুলের ০১৭৭৯৫০০৪৩৮ নম্বর মুঠো ফোনে রেনু পোনা নিতে বিকাশের মাধ্যমে সেন্ট মানি করে ১০ হাজার টাকা অগ্রীম প্রদান করেন।
পরবর্তীতে গত ১২ মে স›দ্ব্যা সারে ৬ টার দিকে আসাদুজ্জামান আরও একজনকে সাথে করে মটরসাইকেল যোগে শহীদুলের বাড়িতে গিয়ে ৫ হাজার পিছ রেনু পোনা ক্রয় করেন। তা অবমুক্ত করতে সহযোগিতা পেতে শহীদুলকে সাথে যাওয়ার অনুরোধ করলে সে সরল বিশ্সাসে রাজী হলে একই মটরসাইকেলে প্রথমে বেতাগী বাসষ্ট্যান্ড হয়ে হোসনাবাদের বাসন্ডা গ্রামের বড় বিশ^াস বাড়ী এলাকায় পৌঁছলে অপহরণকারী আসাদুজ্জামান শহীদুল ও অচেনা লোকটিকে নামিয়ে দেয়। অচেনা লোকটি এর উত্তর দিকে ফসলি জমির উপড় দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে কতিথ ঘের ইট ভাটায় নেওয়া মাটি কাটার পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে দুই জন আচেনা লোক এসে হঠাৎ শহীদুলকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখে একটি গাছের সাথে দুই হাত ও পা বেঁধে আটকে ফেলে।
অপহরণের শিকার শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, রাত অনুমান ৭ টার দিকে আসাদুজ্জামান ঐ স্থানে এসে তাদের পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসাবে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহর করে। রামদা দিয়ে ভয় দেখায় আর হাতের কবজির উপড় জ¦লন্ত সিগারেটের আগুন চেপে ধরে ৫ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে বলেন,‘তোকে মেরে ফেললে অন্যরা ৫ লাখ দিবে, তা না হলে তুই ৫ লক্ষ টাকা দিবি। কোনটা করবি?’ ঐ সময় আরও নানা ভাবে মারপিটও নির্যাতন চালায়। এক পর্যায় রাত ১২টায় সবাই মিলে তার চোখ বেঁধে সেখান থেকে অনুমান রাত ২টার দিকে মটরসাইকেলে করে কাজিরাবাদ এলাকায় একটি অপরিচিত বাড়ীতে নিয়ে তারা পাহাড়ায় থাকেন।
১৩ মে সকাল ৮ টার সময় শহীদুলের সাথের ব্যবহৃত ০১৭৭৯৫০০৪৩৮ মুঠোফোন হতে আসাদুজ্জামান জীবন তার স্ত্রী নিপু বেগমকে অপহরণের বিষয়ে অবহিত করে বলেন,‘স্বামীকে জীবিত ফেরত চাইলে দ্রæত নগদ ৫ লক্ষ টাকা জোগাড় করে কাউকে না জানিয়ে গোপনে তাদের বলা স্থানে নিয়ে আসতে বলেন। এভাবে আসামীরা একাধিকবার তার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে টাকা পৌছে দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে চাপ দেয়। এতে তার স্ত্রী নিপু বেগম ভেঙে ও দিশেহারা হয়ে পরে স্থানীয় ইউপি সদস্য আ: রাজ্জাক মৃধা সহ তাদের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনকে অবগত করেন এবং তাদের কাছ থেকে নগদ ৩ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে অপহরণকারী আসাদুজ্জামান জীবনকে জানালে অপহরণকারীদের বলা স্থানে গোপনে উপজেলার কাজিরাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব কাজিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (চারার স্কুল) এর সামনে আসতে বলেন।
এখানেই শেষ নয়, শহীদুলের বোন রোকেয়া বেগম ও স্ত্রী নিপু বেগম নগদ ৩ লক্ষ টাকাসহ দুপুর ১ টার সময় ঐ স্কুলের সামনে পৌছা মাত্রই আসাদুজ্জামান মুঠোফোনে গোপনে অচেনা এক লোককে দাবিকৃত টাকা দিতে বলেন। তখন স্ত্রী নিপু বেগম তার উত্তরে আসাদুজ্জামান জীবনকে প্রশ্ন করেন স্বামী শহীদুল কোথায়? তাকে ফেরত দিলেই না টাকা দেওয়া হবে। এসময় তার বোন রোকেয়া বেগম কৌশলগত কারণে একটু পেছনভাগে অবস্থান করছিলো। তিনি এক পর্যায় দেখতে পান অচেনা ঐ লোকটি তার ভাইয়ের বউ নিপু বেগমের গালে চর, থাপ্পর আর কিল ঘুসি মারছে। কিছু না বুঝে উঠতেই এরই মধ্যে তার সাথে থাকা ৩ লক্ষ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে সন্ধ্যায় তোর স্বামীকে একই জায়গায় ফেরত পাবে এই বলে মোটরসাইকেল যোগে দ্রæত পালিয়ে যায়।
ঐ দিন রাত ঠিক ৮ টায় অপহরণকারীরা স্থানীয়ভাবে পরিচিত চারার স্কুলের সামনের রাস্তায় চোখ বাঁধা অবস্থায় মটরসাইকেলে করে শহীদুল ইসলামকে নিয়ে এসে চোখ খুলে দিয়ে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। আর অপহরণকারীরা মটরসাইকেলে দ্রæত বেতাগী উপজেলা সদরের দিকে পালিয়ে যায়।
পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় শহীদুলকে নিরাপদে বাড়িতে নিয়ে আসার হয়। শহীদুলের পরিবারের লোকজন জানায়, চিকিৎসা করানো হলেও এখনো সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন নি। এখনো আতকে উঠেন এবং অপরিচিত মানুষ দেখলে কম কথা বলেন ও ভয়ে মুখ লুকায়। একা চলাফেরা করতে পারেন না। কোথাও গেলে লোকজন নিয়ে চলতে হয়।
শহীদুলের চিকিৎসায় সময়ের প্রয়োজন হওয়ায় এ ঘটনায় গত ২০ মে শহীদুলের বোন রোকেয়া বেগম বাদী হয়ে উপজেলার হোসনাবাদের কাটাখালী এলাকার আ: সালাম হাওলাদারের ছেলে আসাদুজ্জামান জীবন ও মোকামিয়া ইউনিয়নের করুণা গ্রামের সুলতান হাওলাদারের ছেলে মো: আলমগীর হাওলাদারের বিরুদ্ধে ৩৬৫, ৩৮৫, ৩৮৬ ধারায় বেতাগী থানায় একটি মামলা রুজু করেন (মামলা নং-১১, তারিখ: ২০-০৫-২০২৫)।
অপহরণের শিকার মাছ ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম বলেন,‘কী আর বলবো ভাই, অপহরণকারীরা যে নির্যাতন করে তার বর্ননার ভাষা আমার নেই। সেই কথা মনে পড়লে এখনো শরীর শিউরে উঠে। আজও সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি। শরীরে ও হাঁটুতে ব্যাথায় কাতরাচ্ছি। আমি কোন অপরাধ করিনি। এর পরেও আমার সাথে এমন অমানবিক আচরণ ও টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে পথে বসিয়ে দিলো কেন? ভবিষৎতে আর যাতে কেউ অপহরণের শিকার না হয় এ জন্য আমি সরকারের কাছে প্রকৃত অপরাধীর সঠিক বিচার চাই।’
শহীদুলের বোন মামলার বাদী রোকেয়া বেগম বলেন,‘ শহীদুল আজ নি:স্ব। তার শরীর ও মন কোনটাই ভালোনা। দার দেনা করে তখন মানুষের কাছ থেকে টাকা এনে দিতে হয়েছে। এখন তা পরিশোধ করতেই হিমশিম খাচ্ছে। কীভাবে ঐ টাকা পরিশোধ করবে একমাত্র আল্লাহই তা ভালো জানেন। তিনি অভিযোগ করেন, আসামীরা এখনো আটক হয়নি। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। জানি না সামনে কপালে আরও কী আছে।
এ বিষয় নিয়ে আসাদুজ্জামান জীবনের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার সাথে ০১৭১৩৯৫৬৪৩৪ মুঠোফোনে কথা বলা সম্ভব হলেও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি ফোন কেটে দেন। কিছুক্ষন পর আরেকটি(০৯৬১১৬৪৫৩১১) নম্বর থেকে সাংবাদিককে হুমকি দিয়ে বলেন, মামলা থাকলেও আপনার কি আসা যায়? কোথায় আমার ফোন নম্বর পেয়েছেন এবং কেন আমাকে ফোন দিলেন এমনই প্রশ্ন রেখে এক পর্যায় কেটে দেন।
জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বেতাগী থানার এসআই মিজানুর রহমান বলেন, ‘তদন্ত চলছে। এখনো সময় লাগবে। আসামীরা পলাতক। ঘটনার কিছুটা সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। তবে পুরোটা এখনো তদন্ত করতে পারিনি। ওরা মোবাইলে বিকাশে ও নগদ টাকা নিয়েছে। এ জন্য বিকাশ কোম্পানীর কাছে চিঠি লিখেছি। ঐ খান থেকে লেনদেনের রিপোর্ট আসলে এর সত্যতা নিশ্চিত হতে পারবো। ঐ সময় ত্রিপল লাইনে ওরা ফোন দিয়ে ছিল। আমাদের পুলিশও ঘটনাস্থলে গিয়ে ছিলো। কিন্ত যাওয়ার আগে টাকার লেনদেন হয়ে গেছে। এ জন্য পুলিশ অপরাধীদের ধরতে পরেনি।’