রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুলাই শহীদ আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলানোর অভিযোগে সরব জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে। পুলিশি হস্তক্ষেপের মুখেও সত্য রিপোর্ট দেওয়ার প্রমাণ ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্ত রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) এর তৎকালীন এসপি আবু বক্কর সিদ্দিককে কর্মকত্রিত্বে বহাল রেখে সম্প্রতি তিনি ময়মনসিংহ রেঞ্জ অফিসে যোগদানসহ এডিআইজি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। নিহতের লাশ রংপুর মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হলে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিবুল ইসলাম ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। তদন্তে তিনি শরীরে পিলেটের অস্তিত্ব এবং পিলেটবিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যুর মতামত দেন। পরে তাকে ওই রিপোর্ট তাজহাট থানার তদন্ত কর্মকর্তাকে দিলে তা গ্রহণ না করে নতুন করে রিপোর্ট লিখতে বলা হয় — ডা. রাজিবুলের জবানবন্দিতে এসব বিষয় উঠে এসেছে। সেই জবানবন্দি তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দিয়েছেন।
ডা. রাজিবুল আদালতে বর্ণনা করেছেন, ৩০ জুলাই রংপুর মেডিকেলের ভাইস প্রিন্সিপালের কক্ষে রংপুর সিটির এসপি আবু বক্কর সিদ্দিক, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মারুফ এবং কলেজের নির্বাহী সদস্য ড. চন্দন তাকে তাদের ইচ্ছেমত রিপোর্ট লিখতে চাপ দেন। রিপোর্টে আবু সাঈদের মাথায় ইনজুরি ফোকাস করতে বলা হয়; পিলেট/বুলেট ইনজুরির বদলে ‘হেড ইনজুরি’ ও ‘নিউরোজেনিক শক’ উল্লেখ করতে চাপ দেওয়া হয়। অভিযোগ, না মানলে মামলা ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেখিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয় এবং পেশাগত প্রলোভন—সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ভ্রমণ কিংবা কক্সবাজারে পরিবারসহ ছুটির প্রস্তাব—দেওয়ার কথা বলা হয়। তবে তিনি এসব প্রলোভনে রাজি হননি এবং নিজের অবস্থানেই অটল থেকেছেন।
ডা. রাজিবুল জানিয়েছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত তার করা রিপোর্টে আবু সাঈদের শরীরে পিলেট ইনজুরির বর্ণনা দেন, যদিও রিপোর্টে সরাসরি ‘গান শট’ শব্দটি উল্লেখ করেননি। তিনি বলেন, টিভিতে লাইভ সম্প্রচারের মাধ্যমে প্রকাশ্যে যে দৃশ্য সবাই দেখেছে সেটি ইগনোর করে অন্যভাবে রিপোর্ট করলে চিকিৎসক সমাজ ও সাধারণ মানুষ হতাশ হবে — তাই তিনি সত্যাগ্রহ করেছেন। তিনি নিজের নিরাপত্তা-ঝুঁকি স্বীকার করে সত্য বলার দাবি জানিয়েছেন এবং হত্যার নির্দেশদাতা ও জড়িতদের বিচারের দাবিতে জোর দিয়েছেন।
স্থানীয় ছাত্রনেতা ও মানবাধিকারকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ লক্ষণীয়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক ইমরান হোসেন বলেন, পুলিশের পুরনো হালবদল হয়নি; জুলাই-বিরোধী কর্মকর্তা এখনও শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। তিনি দাবী করেছেন—আবু সাঈদ হত্যা ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলানোর ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা না হলে আবারো ছাত্র-জনতা রাস্তায় নামবে। রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান সামু পুলিশি ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে দ্রুত তদন্ত ও শাস্তির দাবি করেছেন।
আবু সাঈদের পরিবারও নীরব নয়। নিহতের বড় ভাই রমজান আলী সংবাদ মাধ্যমে বলেন, “পৃথিবীর সবাই দেখেছে—আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। যারা রিপোর্ট বদলানোর চেষ্টা করেছে তাদেরকে কেন বহাল রাখা হচ্ছে — এ প্রশ্ন মেনে নেওয়া যায় না।” তিনি তৎপরতার সঙ্গে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওই কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিককে উচ্চপদে বদলি ও পদোন্নতি দেয়ার পর ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যায়; তারপর তাকে রংপুর রেঞ্জে অ্যাডিশনাল পদে সংযুক্ত করা হলেও আন্দোলন অব্যাহত থাকায় পরবর্তীতে ময়মনসিংহ রেঞ্জ অফিসে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে বদলি করা হয়। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এসবির সাবেক এসপি আবু বক্কর সিদ্দিক অভিযোগ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে রাজি হননি। পুলিশের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, সংশ্লিষ্টদের সম্পূর্ণ তদন্ত করে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা উচিত—তবে কার্যকরি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই সমালোচনা উঠছে।
বিশেষজ্ঞরা ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মনে করিয়ে দিচ্ছেন—একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত না হলে সাধারণ মানুষের পুলিশের ওপরে আস্থা আরও কমে যাবে। স্থানীয় নেতারা ও নিহতের সহপাঠীরা সরকারের ও আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত, নিরপেক্ষ ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।