পটুয়াখালী জেলাজুড়ে স্বাস্থ্যসেবার নামে চলছে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার মহোৎসব। সরকারি অনুমোদন বা লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই শতাধিক বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে প্রতিদিন। নিয়মিত তদারকি না থাকায় এবং প্রভাবশালী মালিকদের ছত্রছায়ায় এসব প্রতিষ্ঠান বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পটুয়াখালীতে ২৪০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮১টির লাইসেন্স বৈধ, বাকি ১৫৯টির অনুমোদন মেয়াদোত্তীর্ণ বা বাতিল। অর্থাৎ জেলার দুই-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠানই অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
বাউফলে ৩৮টি, কলাপাড়ায় ৩৪টি, গলাচিপায় ৩০টি, দশমিনায় ১০টি, মির্জাগঞ্জ ও দুমকিতে ১৩টি করে, সদর উপজেলায় ৮টি, পৌর এলাকায় ৯০টি ও রাঙ্গাবালিতে ৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, বাস্তবে সংখ্যাটি আরও বেশি, কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান নাম বদলে পুরোনো কাঠামোতেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের বড় অংশের মালিক জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। তারা সরকারি হাসপাতালে সেবা না দিয়ে নিজেদের ক্লিনিকেই বেশি সময় দিচ্ছেন। রোগীদেরও বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠানো হচ্ছে, যেখানে সিজার বা অপারেশনের নামে গলাকাটা টাকা আদায় হচ্ছে।
সদর ও উপজেলা শহর ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে, তবুও নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে তাদের কার্যক্রম।
রয়েল ডায়াগনস্টিক, নিউরন ডায়াগনস্টিক, পপুলার ও ইসলামী চক্ষু হাসপাতালসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে নেই এমবিবিএস চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স বা ল্যাব টেকনোলজিস্ট। কিছু প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমাধারী কর্মীরা রোগী দেখা ও প্রেসক্রিপশন পর্যন্ত দিচ্ছেন।
গলাচিপার ‘দি নিউ লাইফ ক্লিনিক’-এ ১০ বেডের অনুমোদন থাকলেও ভর্তি রোগী ৩০ জনের বেশি। ভবনের সামনেই রয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমা। একইভাবে ‘নাইমা কবির ডায়াগনস্টিক’-এ অস্ত্রোপচার-পরবর্তী রোগীরা চিকিৎসকবিহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
ভুল রিপোর্ট, ভুল চিকিৎসা, সংক্রমণ ও অপারেশন জটিলতার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এক রোগী জানান, “রক্তের রিপোর্ট ভুল আসায় ঢাকায় গেলে ডাক্তার বলেন রিপোর্ট ভুয়া।”
আরেকজন বলেন, “ডাক্তার দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন সিজার করতে হবে—না করলে বাচ্চা মরবে।”
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, গত দুই বছরে মাত্র কয়েক দফা অভিযান হয়েছে। ১১টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স বাতিলের প্রস্তাব পাঠানো হলেও কার্যত একটিও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি।
একজন কর্মকর্তা জানান, “জনবল কম, প্রতিষ্ঠান শত শত; নিয়মিত তদারকি সম্ভব হয় না।”
গলাচিপা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ মেজবাহ উদ্দিন বলেন, “বেসরকারি ক্লিনিক সংক্রান্ত মূল নিয়ন্ত্রণ সিভিল সার্জনের অধীনে। তারপরও অনিয়ম পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ খালিদুর রহমান মিয়া জানান, “সব উপজেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ চলছে, তালিকা সম্পন্ন হলেই অভিযান শুরু হবে।”
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডাঃ শের আলী মর্তুজা বলেন, “অপ্রশিক্ষিত লোক দিয়ে চিকিৎসা করানো সরাসরি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বড় বিপর্যয় ঘটবে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, “স্বাস্থ্যসেবায় বাণিজ্যিকীকরণ ঠেকাতে হলে কঠোর নজরদারি ও আইন প্রয়োগ জরুরি।”
বিশেষজ্ঞ ও সচেতন মহলের দাবি, জেলার সব প্রতিষ্ঠান যাচাই করে অনুমোদনহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অবিলম্বে বন্ধ করা, একাধিক প্রতিষ্ঠানে একই চিকিৎসকের নাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ মনিটরিং টিম গঠন করা হোক।
পটুয়াখালীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। লাইসেন্সবিহীন ও অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন এই জেলায় চিকিৎসা নয়—জীবনই থাকবে ঝুঁকির মুখে।