শাহজাহান ফকির—এক সময়ের রাজনৈতিক নেতা, এখন শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির দুর্নীতিগ্রস্ত একক সাম্রাজ্যের প্রতীক। জাল সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে কোটি টাকার প্রকল্প দুর্নীতি, দলবিরোধী আঁতাত, মামলার খসড়া বাণিজ্য—সব মিলিয়ে তিনি দলকে টেনেছেন বিশ্বাসঘাতকতার অন্ধকার গহ্বরে। অথচ বিএনপির “দল বড়, ব্যক্তি নয়” এই মৌলিক নীতির পরিপন্থী হয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আজও তাকেই রেখেছে সভাপতির আসনে। ফলে তৃণমূলে শুরু হয়েছে ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
২০২৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, স্থানীয় বাসিন্দা মো. সেলিম ফকির জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগে জানান, বরমী ডিগ্রি কলেজের এডহক কমিটির সভাপতি শাহজাহান ফকির তার মনোনয়ন ফর্মে একটি ভুয়া স্নাতক সনদ জমা দিয়েছেন। বিষয়টি তদন্ত করে ১৯ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক মো. আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকারের স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে (স্মারক: আইএনএস ০২-১/০০২০১/২০১৭/৫৫১৫/৫৫৭৪) জালিয়াতির বিষয়টি সত্য প্রমাণিত হয়। চিঠিতে বলা হয়, “মো. শাহজাহান ফকির-এর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটি সঠিক নয়, কমিটির সদস্য হিসেবে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে পদচ্যুত করার নির্দেশ দেওয়া হলো।”
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে শাহজাহান ফকির ৩.৩৮ কোটি টাকার বিন্দুবাড়ি-ইজ্জতপুর সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির নজির স্থাপন করেন। প্রকল্পটি ছিল আওয়ামীপন্থী এক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নামে, যা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজের নামে নিয়ে নেন তিনি। এরপর নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করে কাজ শুরু হলে উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুস সামাদ পত্তনদার তা বন্ধের নির্দেশ দেন; কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে কাজ চালিয়ে যান ফকির।
স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, শাহজাহান ফকির একাধিক মামলার খসড়া তৈরি করে তাতে নাম বাদ দেওয়ার বিনিময়ে বিপুল অর্থ আদায় করেন। যারা টাকা দিতে পারেননি, তারা এখন ভুক্তভোগী—হয়রানিমূলক মামলার আসামি।
২০২৪ সালের ১১ আগস্ট সিংগারদিঘীর ‘সী-গাল পার্ক’-এ আওয়ামী লীগ নেতা ও মাওনা ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম খোকনের সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হন শাহজাহান ফকির। বিএনপি নেতাদের হয়রানি না করার শর্তে ১০ লাখ টাকার চুক্তির অংশ হিসেবে ৬ লাখ টাকা তিনি নগদ গ্রহণ করেন। পরদিন, খোকনকে নিয়ে যান শ্রীপুর থানার একটি অনুষ্ঠানে—যার ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
তৃণমূল নেতারা বলছেন, শাহজাহান ফকিরের চাচাতো ভাই ডা. শহিদুল্লাহ ফকির বিবাহ করেছেন বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলমের বোনকে। এই আত্মীয়তার কারণেই কেন্দ্রীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় জেলা পর্যায়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।জেলা বিএনপির ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. এস এম রফিকুল ইসলাম ও ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সাইয়েদুল আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া দেননি।
তৃণমূলের নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন: “শুধু ‘অপেক্ষা’ বলে অপরাধীকে রক্ষা করা মানে, বিএনপির ভিতরে দুর্বৃত্তদের ছায়া দেওয়া হচ্ছে।”
এই মুহূর্তে গাজীপুর জেলা বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—দলের আদর্শ রক্ষা, না আত্মীয়তার রাজনীতি?
দলীয় শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার প্রশ্নে এখনই সিদ্ধান্ত না নিলে ভবিষ্যতের ইতিহাস কোনো দিন ক্ষমা করবে না।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফজলুল হক মিলন বলেন: “আমরা বিষয়টি জানি। জাল সার্টিফিকেট প্রসঙ্গে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো দলীয়ভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এই ক্যাটাগরীর আরো খবর..